Published : Saturday, 14 July, 2018 at 1:01 PM, Update: 14.07.2018 1:06:39 PM
মোঃ শাহ জালাল
প্রায়সই একটা কথা শুনে থাকি রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই, রাজনীতি তার নিজস্ব ঢঙে ও গতিতে চলে। তবে রাজনীতিতে শেষ টা কি হবে বলা না গেলেও বর্তমান রাজনীতির অবস্থান ই কিন্তু শেষ কিংবা ফলাফলের গতিপথ নির্ধারন করে দিচ্ছে। কাজেই আমরা যখন নিকটবর্তী অতীত এবং সমসাময়ীক বর্তমান প্রেক্ষাপটগুলা অনুধাবন করতে পারি তাহলেই যে কোন অবস্থান তথা বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের আদ্যোপান্ত ও এ নিয়ে প্রেডিকশন করাটা সহজ হয়ে যায়।
২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর কথাটা যদিও দেশীয় কিন্তু বৈশ্বিকভাবেও এর মর্মার্থ রয়েছে। বিগত কিছু সময়ের ব্যবধানেই বৈশ্বিকভাবে অনেকগুলো নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। লেবানন, ভিয়েতনাম, ইতালি, তুরস্ক সবশেষে মেক্সিকো নির্বাচন। আমাদের বাংলাদেশেও সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নয়। মনে হচ্ছে যেন জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনের ঢল নেমেছে। ইতিমধ্যে রংপুর, খুলনা এবং গাজীপুরের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ৩০ জুলাই একসাথে রাজশাহী, সিলেট এবং বরিশালে নির্বাচন।
এই যে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হচ্ছে এবং পরবর্তীতে কিছু হবে এগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি ই কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে তার গতিপথ একেঁ দিচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিশেষভাবে কোন ওহি নাজিল হবে না যেটা কোন দলেকে জয়ী করতে সাহায্য করবে!!
কাজেই এই অবধি বড় দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এর অবস্থান কোথায়? নির্বাচনের যেই ফলাফল সেটাতে আওয়ামী লীগ এর জয়গান ই প্রকাশ পাচ্ছে। তাহলে বিএনপির অবস্থা কি? যদি ঘুরিয়ে না বলি তাহলে সেটা অনেকটা নড়বড়েই!!
এই পর্যন্ত কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছাড়া বিএনপির থলিতে কোন নির্বাচনী জয় নেই। ঐদিকে যদি শুধুমাত্র রংপুর কে বাদ দেই তাহলে এছাড়া বাকি সব জয়ই আওয়ামী লীগ এর দখলে। রংপুরে জাতীয় পার্টি হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমান জয় লাভ করেছিল।
যদি রাজনীতির জোন হিসেবে বিশ্লেষন করি তাহলে উভয় দলেরই আলাদা করে তেমন কোন স্পেশালিটি নাই বললেই চলে। কারন রংপুর ও কুমিল্লা জাতীয় পার্টি ও বিএনপির শক্তিশালী জোন। কাজেই এই ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ এর জয় না পেলেও ব্যর্থ বলা যাবে না।
নির্বাচনে বিএনপির এই হাল কেন? গত দু’টা নির্বাচন খুলনা ও গাজীপুর নির্বাচন আদ্যোপান্ত দেখলেই তার কিছুটা হলেও প্রমান মেলে। তবে সেটা কি একান্তই সরকারের ক্ষমতার জোর যদি বলি তাহলে কিছুটা ভুল হবে সেক্ষেত্রে বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান (বিভিন্ন কারন এর অন্তর্ভূক্তি হতে পারে) ও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল অবস্থান, বেগম খালেদা জিয়ার জেল জীবন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকাসহ আরও অন্যান্য ফ্যাক্টর কাজ করছে। খুলনা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নানা অভিযোগ ছিল এবং তার চেয়ে বেশি অভিযোগ হয়েছে সদ্য শেষ হওয়া গাজীপুর নির্বাচনে।
সেখানে হাসান উদ্দিন সরকার প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছে তাদের প্রচারনার সময় বিভিন্ন নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ যেটা পোলিং এজেন্ট কে নিয়ে যেটা আসলেই চোখে পড়ার মতো। প্রায় ৪৬% ভোটকেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি ও পোলিং এজেন্টদের নিয়ে সমস্যা হয়েছে (বিবিস সহ আরও অন্যান্য কিছু লিগাল সোর্স বলছে)। নির্বাচন একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গনতন্ত্র বজায় রাখার পূর্বশর্ত। কথা হচ্ছে সেই নির্বাচনটা ও কিন্তু গনতান্ত্রিক ভাবেই হওয়া উচিৎ। তা না হলে একপাক্ষিক নির্বাচন ই সম্ভব যেটা দেশে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। কথা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাদের ভূমিকা থাকা উচিৎ? অবশ্যই সরকারী দল ও নির্বাচন কমিশনের। সেটা কি তারা আদৌ পালন করছে! আমি সরকারি দলের কথা বাদ দিলাম, যদি নির্বাচন কমিশনের কথাই বলি তারা কি তাদের পুরো দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? মোটেও না। ছোট্ট করে যদি বলি গাজীপুরে নির্বাচনে যেখানে হাসান উদ্দিন সররকা ১ লাখ ৯৭ হাজারের মতো ভোট পায় সেখানে কি করে ৪৬ % ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট এর অনুপস্তিতি এবং তাদের নিয়ে রাজনীতি করতে দেখা যায় সেটা আমার বোধগম্য হয় না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধি ও আইনে স্পষ্ঠ করে বলা আছে পোলিং এজেন্টদের সকল খবরাখবর ও শেষে সকল তথ্য দেয়ার দায়িত্ব রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনের। সেখানে নির্বাচন কমিশনার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে কাজেই কিছুটা নিয়ম ও নীতি বহির্ভূত কাজ তো হয়েছেই খুলনা ও গাজীপুর নির্বাচনে। পরোক্ষভাবে সরকারকে এই দোষ চাপানোর আগে নির্বাচন কমিশনের ওপর তা বর্তানো উচিৎ। সরকার পক্ষ তো চাইবেই বিরোধী দলকে রণক্ষেত্রে পরাজিত করতে!! এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে সবার অংশগ্রহণমূলক ও গনতান্ত্রিকভাবে করার জন্য ইসিকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং সাংবিধানিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই সাথে সুজনের সম্পাদক নির্বাচন কমিশনকে ৬-৭ টির মতো উপদেশ ও বিধিমালাও দিয়েছেন নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য। দু’দিন আগে নির্বাচন কমিশনের প্রধান নুরুল হুদাও বলেছে আমাদের বিশ্বাস বিএনপি এবার নির্বাচনে আসবে এবং সেই সাথে এই নির্বাচনে সুষ্ঠ ও পূর্ণতা নিয়ে আসবে।
এইবার আসা যাক ৩০ এ জুলাইয়ের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে! কেমন হবে এই নির্বাচন? আমার জানা মতে, গত নির্বাচনে ম্যাক্সিমাম সিটিতেই বিএনপির জয়ের দখলে ছিল। এবারে তিনটি সিটিতে কর্পোরেশন নির্বাচন হবে। সিলেট, রাজশাহী ও বরিশালে। রাজশাহী ও বরিশালে বিএনপির একক প্রার্থীতা আছে কিন্তু সিলেটে এই প্রার্থীতার রাজনীতিটা কিছুটা ঘোলাটে, যেখানে তিনটি সিটিতেই আওয়ামী লীগ এর একক প্রার্থীতা রয়েছে এবং জোটগত কোন সমস্যা নেই। অপরদিকে সিলেটের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হকসহ ২০ দলীয় জোটের জামায়েত এর জোবায়েরের প্রার্থীতা এবং সাথে বিএনপির ই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আরেকজন নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এ যেন মরার ওপর খড়ার ঘা!! সুতরাং এ থেকেও বোঝা যাচ্ছে বিএনপি জোটে কিছুটা হলেও ফাটল ধরছে!! এই কনফ্লিক্ট মেটানোর জন্য কেন্দ্র থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরুসহ আরও কিছু নেতা গিয়েছিল কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি।। যদিও জামায়াত বলে আসছে অন্যান্য নির্বাচনগুলোতে আমরা বিএনপির প্রার্থিতাকে সমর্থন করে আসছি এবং আমাদের সেই মনোবল আছে যে সিলেটের নির্বাচনে ভাল কিছু করতে পারবো, সেই কারনেই আমাদের প্রার্থীর ঘোষনা সিলেটে। তাই সম্ভবতো আগামী জাতীয় নির্বাচনে কিছু অসঙ্গতির সাথেও জোটের এই ভঙ্গুর অবস্থা অনেক ভোগান্তিতে ফেলবে বিএনপিকে যেটার প্রভাব আগামী নির্বাচনেও পড়তে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমসাময়ীক কিছু নাটকীয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখন দিল্লীমুখি হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির লাড্ডুর প্রেমে তারা আপাতত হাবুডুবু খাচ্ছে। কথায় আছে না দিল্লিকা লাড্ডু!! আওয়ামী লীগ এর সখ্যতা ভারতের সাথে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই, অনেকটা মামার বাড়ির মতোই। একটা রাজনৈতিক দলের কোন একটা প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক থাকতেই পারে। সেটা দোষের কিছু না!! কিছুদিন আগেও বিএনপির নেতৃবৃন্দের এক গ্রুপ গিয়েছিল দিল্লিতে রাজনৈতিক ধরনা দিতে। এই বিষয়টা অনেক চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে এবং রাজনীতির কিছুটা মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে। সেই সুবাধে কয়েকদিন আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামও গিয়েছিল দিল্লিতে।
বেগম খালেদা জিয়া জেলে আছেন বেশ অনেকদিন হয়, তাঁর আইনজীবি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন বিটিশ লর্ড কার্লাইল। মজার বিষয় হচ্ছে উনিও বাংলাদেশের ভিসা না পাওয়ায় দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেখান থেকে ই প্রমান করবে যে রাজনৈতিক কারনেই বেগম খালেদা জিয়াকে আটক করা হয়েছে, এতিমের টাকা আত্মসাৎ এর জন্য নয়। কেন দিল্লি??? কাজেই বুঝা যাচ্ছে আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত কতোটা গুরুত্বপূর্ন তা বলার অপেক্ষা রাখে না!! এসকল ঘটনাই তার প্রমান। এ দিক থেকেও বিএনপির দুর্বল অবস্থান আওয়ামী লীগ থেকে।
কিছুদিন পর আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা হবে। তবে এতোদসত্বেও বিএনপি নির্বাচনের জন্য কি প্রস্তুত? সম্ভবতো না। যেখানে আওয়ামী লীগ কে দুই তিন মাস আগে থেকেই দেখছি নির্বাচনের প্রচারনা চালাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী প্রচারনা আরম্ভ করছে সিলেট থেকে। কেন জানি না বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারনার উদ্ভোধন ঘটায় সিলেট থেকেই। ধর্মীয় কারন ও অনুভূতি হয়তোবা কাজ করে এই ক্ষেত্রে। পরে অনেক জায়গা হয়ে এখনও চালাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ এর বর্ধিত সভায় উনি তৃণমূল পর্যায়েও কঠোরভাবে প্রচারনা চালাচ্ছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ শক্ত আট-শাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে। সেই তুলনায় বিএনপির প্রচারনা নাই বললেই চলে। প্রত্যেকটা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেখানে সরকার পক্ষ জোরেসোরে তাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রচারনা চালাচ্ছে এবং সফলতার বিভিন্ন আশার বানী শুনাচ্ছে আর সেখানে বিএনপি তাদের নেত্রীকে জেল থেকে ছাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত ও শুনতে হয় তাদের নানা অভিযোগের কথা। এখানেই এই বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে পার্থক্য। কাজেই বিএনপির এই নড়বরে অবস্থা আগামী নির্বাচন তাদের জন্য কতোটা ফলপ্রসূ হবে তা ভাববার বিষয়!
সুতরাং সুজনের সম্পাদকের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে চাই জাতীয় নির্বাচনে ইসির ভূমিকার বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক এই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিকভাবে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সুবিধা দিলেই আগামীতে সুন্দর ও সবার অংশগ্রহণমূলক একটা সুন্দর নির্বাচন দেখতে পারবো, যেটা আমার মতো সকল সাধারণ নাগরিকদেরই কাম্য।
লেখক: মোঃ শাহ জালাল শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।