Published : Wednesday, 1 November, 2023 at 1:51 PM, Update: 02.11.2023 11:41:23 AM
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংশের নির্মম খেলায় মেতে উঠেছে মানুষ। সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমাগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নদীভাঙনের কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমছে বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনভূমির আয়তন। যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।
ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, সুন্দরবনের আয়তন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা। কমে আসছে গাছগালা, লতাগুল্ম ও প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বলও হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের ওপর আর নির্যাতন নয়, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এই বন একসময় হারিয়ে যাবে, সেইসঙ্গে হুমকিতে পড়বে বাংলাদেশের অস্তিত্ব।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯০৪-২৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।
এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯০৪-২৪ সালে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৭ হাজার ১৪২ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন কমে ৬ হাজার ৮৭১ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১০০ বছরে সুন্দরবনের ২৫২ বর্গকিলোমিটার হারিয়ে গেছে। এর অর্থ, প্রতিবছর আড়াই বর্গকিলোমিটারের মতো বন হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিমাণ জমির আয়তন আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফার ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান।
জীববৈচিত্র্যের জন্যও সুন্দরবন অনন্য। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বনে ৫২৮ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম আছে, আছে ৩০০ প্রজাতির পাখি। ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী সুন্দরবনে চরে বেড়ায়। সুন্দরবনের নদী-খালে ২৫০ প্রজাতির মাছ আছে। আছে বহু প্রজাতির কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক। আছে নানা ধরনের ছত্রাক, শেওলা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এই সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকলে, তা শক্তিশালী দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারবে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে। এছাড়া পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই বনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, বণ্যপ্রাণী শিকার, দূষণ, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, অনিয়ত্রিতভাবে গাছকাটা, সচেতনতার অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে বনের মূল্যবান প্রাণিসম্পদ। একসময় এ বনে বাস করত ৪০০ প্রজাতির পাখি। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭০ প্রজাতিতে। বিলুপ্ত হয়েছে ১৩০ প্রজাতির পাখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে সাগর-নদীর পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা। তাই কমে যাচ্ছে কম লবণসহিষ্ণু সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছ, কমছে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্রও।
বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জলভাগ। এ বিস্তীর্ণ নদী ও খালে রয়েছে ১২০ প্রজাতির মাছ। জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে ডলফিনের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া রাতে চলাচলের সময় টর্চ লাইটের তীব্র আলো ও শব্দ হরিণ এবং নিশাচর প্রাণীসহ সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফলেছে।
সুন্দরবনের বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক, গ্রেট নট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙেয়), দুই প্রজাতির উদবিড়াল ও লোনা পানির কুমির ইত্যাদি।
প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের একাধিক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলেছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সুইডবায়ো, বন অধিদপ্তর, ফরেস্ট পিপল প্রোগ্রাম (এফপিপি) ও উন্নয়ন অন্বেষণের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘দি ইমপ্লিমেনটেশন অ্যান্ড মনিটরিং অব দ্য কুনমিং-মন্ট্রিল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক: কমিউনিটি বেসড সলিউশন অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশনস টু দ্য গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি টার্গেটস।’ শীর্ষক এক কর্মশালায় বক্তারা বলেন, এক দশকে বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম সুন্দরবনের আয়তন অন্তত অর্ধেক কমে গেছে। এভাবে বন কমতে থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক।
তারা বলেন, সুন্দরবনের জলাধার কমেছে। ২০১০ সালে যেখানে ছিল ৪৪৮ হেক্টর, ২০২০ সালে তা ৩২২ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁকড়া বিচরণস্থল ৩ হাজার ১১৫ হেক্টরে থেকে কমে ১ হাজার ৬৩৪ হেক্টরে নেমে এসেছে। সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সুন্দরবনের ১০ শতাংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যের হটস্পট রয়েছে। আমরা ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছি। এজন্য আমরা স্থানীয় লোকজনকে বন ব্যবস্থাপনায় সহযোগী হিসেবে গড়ে তুলছি। কুনমিং-মনট্রিল প্রোটোকল অর্জনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যে উঠে আসে, সুন্দরবনের আয়তন কমার পাশাপাশি কমছে মৎস্যসম্পদও। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজতে হবে। সুন্দরবনে পরিকল্পিতভাবে গোলপাতার গাছ রোপণ করে এটাকে বাড়তে দিতে হবে। এখানকার জেলেরা যেন নিয়ম মেনে মাছ ধরেন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের মাছ ধরা যাবে না। যে মাছগুলো বিপন্ন সেগুলো ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখতে হবে। আর জেলেদের জালের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিয়ম মেনে চলতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের মধ্যে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বৃদ্ধির হার বছরে ৩ থেকে ৮ মিলিমিটার। ইতিপূর্বে এ বন থেকে গণ্ডার, বনমহিষ, মিঠাপানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ ও ৪ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ।
দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এ বন কাঠের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়া কাঠ, জ্বালানি ও মণ্ডের মতো প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি সুন্দরবন থেকে ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া ও শামুক-ঝিনুক ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয়। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের ভূমি একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে প্রাকৃতিক প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। সিডর, আইলা, ফণী, আম্ফান, বুলবুলসহ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ম্যানগ্রোভের প্রাচীর কতটা শক্তিশালী সেটা সুন্দরবন বারবার জানান দিয়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট আঘাত পেতে পেতে এখন সুন্দরবন নিজেই বিপদের মুখে পড়েছে। এজন্য দেশের স্বার্থেই সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়লে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সুন্দরবনের আয়তন কমে আসায় প্রতিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে আসছে গাছগালা, লতাগুল্ম ও প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এটি কোনো ইতিবাচক লক্ষণ নয়।
সুন্দরবনের মধ্যে ছোট-বড় অসংখ্য নদী ও খাল রয়েছে। পানির মতো বিছানো এসব খাল-নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। এসব নদী-খাল দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভরে যায়, আবার দুবার ভাটায় পানি নেমে যায়। জোয়ার-ভাটার কারণে নদীর পাড় ভাঙে আবার গড়ে। তবে গত ১০০ বছরে দেখা গেছে, ভাঙনই বেশি, যা আজও ঠেকানো যায়নি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।