আগুন শুধু ঘর-বাড়ি পোড়ায় না, পোড়ায় মানুষের জীবন, মানুষের স্বপ্নগুলোকেও করে তোলে বিবর্ণ। এক একটি আগুনের ঘটনায় জন্ম নেয় এমন সব কিছু হারানোর বহু গল্প। রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তিতে রোববার (২৪ মার্চ) বিকেলে লাগা আগুনের ঘটনাও এমন সব দৃশ্যপটেই জন্ম দিয়েছে।
বস্তিবাসীর কাছে কড়াইল বস্তির এক অংশ এখন যেন এক বিবর্ণ ধ্বংসস্তূপ। বস্তির প্রায় দুই শতাধিক ঝুপড়ি ঘরের কোনোটিই অক্ষত নেই। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষদের এই বসতি।
ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায় পথে বসে বসেছে এসব ঘরের বাসিন্দারা। থাকার জায়গা, বিছানা, বাতিল তোশক, রান্নার হাড়ি পাতিলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই আগুনে গ্রাসে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন ভুক্তভোগীরা। সামনের দিনগুলো এখন তাদের কাছে কেবলই ধুসর, অনিশ্চিত।
দেড় ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে আসতেই, পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় নিম্ন আয়ের মানুষের বাসস্থান। অন্তত শতাধিক টিনের ঘর পুড়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আগুনে ঘরবাড়ি আর আসবাবপত্র হারিয়ে পথে বসেছে কয়েকশ’ মানুষ। কোথায় কাটবে রাত, উত্তর নেই কারো কাছে।
বনানীর কড়াইল বস্তির বেশিরভাগ বাড়ি টিন ও কাঠের। একেকটি বাড়ি টিন দিয়েই তিন-চারতলা করা হয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি করা এসব ঘরের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। বস্তির আশপাশের বাড়িগুলোতেও আগুন নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
সর্বস্ব পুড়ে যাওয়ায় বস্তিবাসীদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আগুনের সব হারানো শিমু আক্তারের ভাষায়, আমার ঘরের কিছুই বাঁচাতে পারিনি। আগুনে পুড়ে সব শেষ। একেবারে পথে বসে গেলাম। নিঃস্ব হয়ে গেলাম। গায়ের কাপড়টা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন আমি কী করব।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, হঠাৎ লাগা আগুন থেকে রক্ষার পাবার জন্য রান্নার হাড়িও বের করতে পারেননি তারা। পুড়েছে শিক্ষার্থীদের বইখাতা। পুড়ে যাওয়ার পরও ধ্বংসস্তূপে কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা, তার সন্ধানে নেমেছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা।
তারা বলছেন, আগুনের খবর পেয়ে বাড়িতে আসতে আসতেই সব শেষ। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ষাটোর্ধ এক নারীর সব হারানোর আর্তনাদ। মাথা গোজার ঠাইও হারিয়েছেন তিনি। ফোনে স্বজনদের জানাচ্ছিলেন, আগুনে নিঃস্ব হবার কথা। তার ঘরে ছিলো খাট, ফ্রিজসহ অন্যান্য আসবাবপত্র। এক ঘণ্টায় সব পুড়ে শেষ।
আরেকজন ক্ষতিগ্রস্ত জানান, ঘটনার সময় তিনি বাইরে ছিলেন। আগুন লাগার খবর শুনে তাড়াতাড়ি ছুটে এসে দেখেন কিছুই নেই। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সারা জীবনের কষ্ট দিয়ে গড়া সব জিনিসপত্র ও স্বর্ণের গয়না পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পথের ফকির হয়ে গেছেন। শুধু মুরগির দুটি খাঁচা বের করা গেছে।
আগুনে সব হারানো বৃদ্ধ বসু মিয়া বলেন, আমি নামাজে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে শুনি আগুন লেগেছে। তখন দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকি। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে সব অন্ধকার হয়ে যায়। মানুষজন আমাকে টেনে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। লুঙ্গি, গামছা আর মোবাইল ছাড়া আমার কাছে এখন এক টাকার সম্পত্তিও নেই।
রোববার বিকেল ৪টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয় বনানীর এ বস্তিতে। সোয়া ৪টায় ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় পরে আরও ৭টি ইউনিট যোগ দেয়। ১০ ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় বিকেল সাড়ে ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।