অভিবাসন একটি আদিম এবং ক্রমবর্ধমান প্রকৃয়া। জাতিসংঘের ২০১৯ সালের তথ্য মতে বিশ্বে প্রায় ২৭২ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসী হিসেবে রয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে বিশ্বের প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ উন্নত জীবন, শিক্ষা, কাজ কিংবা শরনার্থী হিসেবে কোন না কোন দেশ বা শহরে অভিবাসী হচ্ছেন। আমরা উন্নত জীবনের নেশায় কিংবা উচ্চ শিক্ষা অথবা দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিশ্বের নানান দেশে পাড়ি জমিয়ে আসছি সেই আশির দশক থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২ মিলিয়ন বাংলাদেশী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মধ্যপ্রাচ্যে।
ইউরোপের ২৭ টি দেশে রয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন বাংলাদেশী অভিবাসী যার বেশীর ভাগ এসেছেন উন্নত জীবন, উচ্চ শিক্ষা অথবা শরনার্থী হিসেবে। বিগত দুই দশকে যদিও অল্পসংখ্যক মানুষ কৃষি, পর্যটন, নার্সিংহোমে কিংবা নার্স হিসেবে দক্ষ অথবা আধা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষই অদক্ষ হিসেবে এসেছেন এবং বসবাস করছে। যদিও অনেকে দীর্ঘদিন একই পেশায় যুক্ত থাকার ফলে একটি নিদিষ্ট সময়ে গিয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠেন বিশেষ করে রেস্টুরেন্টে, বার কিংবা কপি শপে।
বেশীরভাগ ইউরোপীয় বাংলাদেশী অভিবাসীদের ঘন ঘন কাজ পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু এখানে সব কাজকে সমান ভাবে দেখা হয় এবং সম্মান প্রদর্শন করা হয় তাই এই ক্ষেত্রে তেমন কোন অসুবিধা বা বৈষম্যের বিষয় থাকে না। সামার বা গ্রীষ্ম ভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্য এবং এখানকার বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হওয়ার ফলে বছরে শুধুমাত্র ৭/৮ মাস কাজের সুযোগ বেশী থাকে। বাকি সময়গুলো তুলনামূলক কাজ কম থাকার ফলে অনেক মানুষকে বেকার অথবা ছুটি কাটাতে বাড়ী চলে যেতে হয়!
বিগত দুই দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, ইটালি, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে বাংলাদেশী অভিবাসীরা উদ্যোক্তা হিসেবে নানা ধরনের ব্যবসা বানিজ্য শুরু করেছে যা খুবই আশাব্যঞ্জক কিন্তু তা সংখ্যা বিবেচনায় নেহাৎ খুবই কম। বৈধ অভিবাসীদের বিভিন্ন দেশ সহজ শর্তে নতুন ব্যবসা বানিজ্য করার নানান সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে কিন্তু বেশীরভাগ অভিবাসী তা সঠিকভাবে না জানার ফলে সেটিকে কাজে লাগাতে পারছে না। ফলে চাকরির জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় সবসময়।
তাছাড়া যারা নতুন করে অভিবাসী হয় তাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশী। বিশেষ করে ভাষা এবং সাংস্কৃতি, নতুন পরিবেশে সম্পুর্ন আলাদা নিয়মে কাজের সক্ষমতা সহ নানান জটিলতায় পড়তে হয়। তার জন্য হয়তো অনেকে প্রস্তুত থাকে না কিন্তু চাইলে তারা তাদের সেই নতুন এবং প্রতিকূল পরিবেশের জন্য গড়ে তুলতে পারেন। বিশেষ করে যেই যে দেশে আছে সেখানকার ভাষা এবং সাংস্কৃতি জানা জরুরি প্রথমত। তারপরে রয়েছে দক্ষতা উন্নয়ন ব্যাক্তিগত এবং কাজের যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকেই যেই ভুলটি করে তা হলো অন্য কারো সফলতা দেখে তা অন্ধভাবে অনুকরণ করা ফলে সল্প সময়ের ব্যবধানে তা ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়ে পথে বসতে হয়। পরবর্তী সময়ে অন্যকোন ভাল উদ্যোগ গ্রহনের অন্তরায় হয়ে উঠে। তাই কোন ব্যবসা বা উদ্যোগ গ্রহনের পূর্বে তা যথাযথ ভাবে জানা তার ভাল ও মন্দ দিক। সবচেয়ে ভাল হয় যদি সেই সম্পর্কে বাস্তবিক ধারনা অর্জন করা যায় মানে সংশ্লিষ্ট খাতে একটি নিদিষ্ট সময় কাজের অভিজ্ঞতা সফলতাকে অনেক বেশী তরান্বিত করে।
তাছাড়া ইউরোপের বেশীরভাগ দেশে অভিবাসীদের ভাষা ও দক্ষতা উন্নয়নে সরকারি বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান এবং অনেক উদ্যোগ রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং সহজ শর্তে ব্যাংক লোন পাওয়ার সুযোগ। স্থানীয়দের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বাস্তবিক অভিজ্ঞতা এবং ধারনা লাভের জন্য রয়েছে বহুমুখী সেমিনার এবং প্রশিক্ষণ। কিন্তু দুঃখজনক হল সেসব বিষয়ে আমাদের তেমন আগ্রহ নেই বা মনমানসিকতা নেই। ফলে সারাজীবন কারো না কারো উপর নির্ভরশীল অথবা একটি নিদিষ্ট সীমানার বাহিরে যেতে পারে না।
যেমন পর্তুগালে হাই কমিশন ফর মাইগ্রেশন (ACM), সেন্টাল এম্প্লয়মেন্ট (IEFP) এবং অভিবাসীদের জন্য জাতীয় সহয়তা কেন্দ্র (CNAIM) সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অভিবাসীদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। যেখান থেকে অভিবাসীদের বিভিন্ন সেবা, তথ্য, পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বাস্তবিক সেইসব প্রশিক্ষণ নিয়ে অভিবাসীরা নিজের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি পেতে পারে আর্থিক সুবিধা। উদ্যোক্তা উন্নয়নের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে সহজ শর্তে এবং বিনা সুদে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার সকল সহযোগিতা করে থাকে এই সকল প্রতিষ্ঠান সহ বেসরকারি অনেক সংস্থা।
আমাদের বাংলাদেশী অভিবাসীদের স্বেচ্ছাশ্রম বা ইন্টার্ন হিসেবে স্থানীয় কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার মানষিকতা একেবারেই কম ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় মানুষজন এবং তাদের কার্যক্রম ও কার্য প্রণালি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় না। তাই সুযোগ থাকার সত্ত্বেও এখানকার মেইনস্ট্রিমে কাজ করার বা সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে অভিবাসীরা। প্রত্যেক দেশের অভিবাসীদের তাদেরকে দক্ষ মানবসম্পদ এবং সেই দেশের স্থানীয় উন্নয়ন মূলত কর্মকান্ডে সংযুক্ত করার নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে।
শুধুমাত্র সঠিক তথ্য ও যথাযথ সদিচ্ছা থাকলে একজন অভিবাসী এখানে নিজেকে প্রমান করতে পারে সহজেই। কেননা এখানে বৈধ সবার সবকিছুতে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিবাসীরা অগ্রাধিকার সুবিধা পেয়ে থাকে অনেক কাজে বিশেষ করে অভিবাসন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে। তাই শুরুতে নিজেকে তৈরি করা উচিত সবাইকে যেকোনো দেশে স্থায়ী হতে হলে। তাহলে ভবিষ্যৎ পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং দীর্ঘ মেয়াদি অনেক কিছুর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা যায়।
লেখক : পর্তুগাল প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক শিক্ষার্থীঃ ক্রিয়েটিভ লিডারশীপ প্রোগ্রাম
উপদেষ্টা সম্পাদক ব্রি. জে. (অব.) আবদুস সবুর মিঞা এনামুল হক ভূঁইয়া ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : এম. এ হান্নান যুগ্ম-সম্পাদক মোহাম্মদ রুবাইয়াত আনোয়ার মেবিন হাসান