Published : Friday, 27 December, 2019 at 6:43 PM, Update: 27.12.2019 8:43:28 PM
ঘুম থাইক্কা উইঠা শুধু জান নিয়া বাইরে আইছি
শারীরিক প্রতিবন্ধী নাছির মিয়া ঘরে রাতের খাবার শেষ করে স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে ৮টার দিকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যান। রাত পৌনে ৩টার দিকে যখন বস্তিতে ফেরেন ততক্ষণে সব পুড়ে শেষ। বসবাসের যে জায়গাটিকে যাওয়ার সময় প্রাণবন্ত রেখে গেছেন, ফিরেই দেখেন সে বস্তির একাংশ কয়লায় পরিণত হয়েছে। সেখানে অস্তিত্বহীন তার ঘরও। ফিরেই স্ত্রী-সন্তানের চিন্তায় অনর্গল কান্না করতে থাকেন নাছির মিয়া। পরে জানতে পারেন, পরিবারের সবাই নিরাপদে ঘর থেকে বেরিয়েছেন। তবে শীতের রাতে গায়ে থাকা কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে বের হতে পারেননি প্রতিবন্ধী নাছিরের স্ত্রী-সন্তানরা।
শুধু নাছির মিয়াই নন, বৃহস্পতিবার (২৭ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ১২টার দিকে রাজধানী কালশীর বাউনিয়া বাঁধ এলাকার ওই সি ব্লক বস্তিতে লাগা আগুনে পাঁচ শতাধিক পরিবার নিজেদের সবই হারিয়েছেন। তাদের অনেকেই এখন খোলা আকাশের নিচে। কেউ বা স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।
রাত সোয়া ১২টার পরপরই মূলত ওই বস্তিতে আগুন লাগে। তবে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর আগুনের খবর পায় রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে। এরপর সেখানে পাঁচটি ইউনিট পাঠানো হয়। পরে পাঠানো হয় আরও ছয়টি ইউনিট। ১১ ইউনিটের চেষ্টায় রাত সোয়া ২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে আগুনে পুড়ে যায় বস্তিটির দুই শতাধিক ঘর। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন পাঁচ শতাধিক বাসিন্দা। এতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও বস্তিবাসীর কান্না নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকেলে বাউনিয়া বাঁধের ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে জিনিসপত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী। তবে টিন ও ঘরের লোহার আসবাবপত্র কিছুটা উদ্ধারযোগ্য হলেও বাকি সব কয়লাই। সেসবই টেনে বের করে আনছেন সর্বহারা বস্তিবাসী।
সেখানে কথা হয় নাছির মিয়ার সঙ্গে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। চার ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গত সাত বছর ধরে এ বস্তিতে বসবাস করছেন। বস্তিতে তার নিয়ন্ত্রণে ছিল ১০টি ঘর। প্রতি ঘর থেকে তিনি ভাড়া পেতেন হাজার থেকে ১২০০ টাকা করে।
তিনি বলেন, ‘এভাবে পুইড়া সব শ্যাষ হইয়া যাইব ভাবি নাই। আমি তো কিচ্ছু জানতাম না। রিকশা নিয়া রাতে খ্যাপ মারতে গেছিলাম। মনটা খুব খচখচ করছিল। পৌনে ৩টার দিকে আইসা দেখি ধোঁয়া আর মানুষের জটলা। কাছে আইসা দেখি সব পুড়ে ছাই।’
স্ত্রী হাজেরা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মেয়ে ঝর্ণাকে জর্ডান পাঠানোর লাগি গ্রাম থাইক্কা সুদে লোন কইরা এক লাখ টাকা আনছিলাম। ঘরে ছিল আরও ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু আগুনে কিচ্ছু নিতে পারি নাই। ছোড বাচ্চাদের নিয়া কোনোরকমে এক কাপড়ে জানডা নিয়া বাইরে আইছি।’
আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপের উপর মুখে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় ভাঙারি দোকানদার রহমত আলীকে। কিশোরগঞ্জের এ বাসিন্দা ওই বস্তিতে আছেন দীর্ঘদিন।
তিনি বলেন, ‘দোকান বন্ধ কইরা স্ত্রী রিনা আক্তার ও চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঘুমাইছি। ঘুমের মধ্যে মানুষের চিৎকার। বাইরে বাহির হইতেই আগুনের তাপ লাগে। ঘরে ঢুকেই চিৎকার দিছি। সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যাই। আগুন নেভার পর দোকান কিংবা বসবাসের ঘর বলতে কিচ্ছু নাই। গরু পুড়ছে, দোকান পুড়ছে, ঘর পুড়ছে। সব পুড়ে মাটির সাথে মিশে একাকার।’
পুড়ে যাওয়া ঘরে বসে থাকতে দেখা যায় রহিমা বেগমকে। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগছে বলতে পারিনি। কারণ বস্তির শেষ প্রান্তে বাসা। আগুনের খবরে ছুটে আইসা দেখি দোকান পুড়তাছে। আহাজারি করছি। কিন্তু দোকান বাঁচাতে পারিনি।’
দুই সন্তানের মা ফাতেমা বেগম সব হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আনন্দ নিকেতন মডেল স্কুল প্রাঙ্গণে। সেখানে খাবারের অপেক্ষায় আছেন দুই সন্তানকে নিয়ে। স্বামী শাহজাহান ময়লা গাড়িতে কাজ করেন।
তিনি বলেন, ‘ঘর, জিনিসপত্র বাঁচামু নাকি বাচ্চাদের নিয়া জান বাঁচামু। কোনোরকমে বাইরে আইছি, চোখের সামনে চেয়ে চেয়ে সব পুড়তে দেখছি, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। এখন সব শেষ। কষ্ট লাগতেছে, শীতের সময়ে বাচ্চাদের পরনের লাগি কোনো শীতের কাপড়ও নিতে পারি নাই।’
ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী জানান, বাউনিয়া খালের উপরে বাঁশ আর কাঠের মাচায় তৈরি করা পাঁচ শতাধিক ঘরে বসবাস ছিল হাজারো বাসিন্দার। রাতের আগুনে বস্তির ৮০টির মতো দোকানসহ দুই শতাধিক ঘর পুড়েছে।
কাঠের টং ঘরের উপরে দুই তলার ঘরও নির্মাণ করা হয়েছিল। ভাঙারি দোকানে প্লাস্টিক আর কাগজের কারণে আগুন আরও বেশি বেগবান হয়েছে। বাসিন্দাদের অধিকাংশই রিকশা-ভ্যানচালক। কেউ বা ভাঙারির ব্যবসা করেন, ফেরি করে প্লাস্টিক সামগ্রী ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা-১৬ আসন) মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, ‘বস্তিটিতে লাগা আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদে রাতের থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা করেছি। প্রত্যেক বেলায় তাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় আরমান স্কুল ও আনন্দ নিকেতনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় গরম কাপড় বিতরণ করা হবে।’
উপদেষ্টা সম্পাদক ব্রি. জে. (অব.) আবদুস সবুর মিঞা এনামুল হক ভূঁইয়া ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : এম. এ হান্নান যুগ্ম-সম্পাদক মোহাম্মদ রুবাইয়াত আনোয়ার মেবিন হাসান